top of page

সমুদ্রসমগ্র

  • Writer: সাদিয়া সুলতানা
    সাদিয়া সুলতানা
  • Jun 21, 2020
  • 3 min read

আগে না ঘুমাতে পারা রাতগুলো বিষণ্ন মনে হতো, এখন দিনগুলোও ক্রমাগত বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছে। সুরহীন, ছন্দহীন কর্মব্যস্ত দিন কাটছে।


অবরুদ্ধ জীবনে সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তটি আবিষ্কার করি ঠিক তখন, যখন শরীরে এতটুকুও বাতাসের ছোঁয়া লাগে না। আগে কাজের ফাঁকেফাঁকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালে ঝিরঝিরি বাতাস শরীর ছুঁয়ে দিতো, ছুঁয়ে দিতো কর্মক্লান্ত মন। এখন ভেতর বাইরে একই দশা। এক ফোঁটা বাতাস নেই কোথাও। রোদের ফালিও চোখে পড়ে না। রোদ ওঠে ঠিকই। আমার দেখা হয় না। ঘরকন্নার কাজ সেরে বারান্দায় দাঁড়াতে দাঁড়াতে রোদের কণা নাগালের বাইরে চলে যায়।


এই রোদের সঙ্গে মানুষের খুব মিল। ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকে, ফের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। একেবারে মানুষের মতো।


আজ সকালে খবর পেলাম আমার নানি মারা গেছে। ভাই জানালো মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুই ঘন্টা ধরে খোঁজ করেও কোনো ডাক্তার পাওয়া যায়নি। কাফনের কাপড়ের দোকানও বন্ধ ছিল। করোনা সংক্রমণ রোধ করতে কম-বেশি সবাই এখন বাড়িতে থাকছে। সারাদেশে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনেরা তবু অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে জানাজার নামাজে এসেছেন। কিন্তু উপস্থিতি কম ছিল। অথচ নানির যতজন ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি আছে সকলে এলে বিশাল জনসমাগম হবার কথা।


গত এক বছরের ভেতরে আমাদের পরিবারের সব বর্ষীয়ান মানুষ একে একে চলে যাচ্ছেন। এইসব মৃত্যু স্বাভাবিক। ভেজা ভেজা মনে মৃত্যুকে মেনে নিচ্ছে সকলে।


আসলে মৃত্যু বিষয়টাই হয়তো খুব স্বাভাবিক। বেঁচে থাকাটাই অস্বাভাবিক, অনিশ্চিত।


ছাব্বিশ বছর আগে বাবার মৃত্যু ছাড়া কোনো নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুকালে আমার উপস্থিত থাকা হয়নি। তবে মৃত্যু দেখেছি খুব কাছ থেকে। এই বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি আমার চোখের সামনে একজন লোক আচমকা পড়ে গিয়েছিল। ফুট সাতেক দূরে দাঁড়ানো লোকটি মারা গিয়েছিল দু-তিন মিনিটের ভেতরে। তার কাপড়-চোপড় প্রস্রাবে ভিজে গিয়েছিল, স্ট্রোক করেছিলেন তিনি। লোকটি ছিলেন একটি দেওয়ানী মোকদ্দমার বাদী। ডকে দাঁড়ানো বিবাদী মহিলাটি তখন সাক্ষ্য দিচ্ছিল। বাদী যখন পড়ে যাচ্ছিল, মহিলাটি ক্ষুব্ধস্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল, ‘অয়ই তো আমারে জ্বালায়।’ অ্যাম্বুলেন্স এসে লাশটা নিয়ে যাবার পর পিয়ন জানিয়েছিল, 'লোকটা এলাকার দেওয়ানী, মামলা-মোকদ্দমা করে বেড়ায়।'


বিষয়টা কি অদ্ভুত, তাই না? আমরা ভাবি মরে গেলেই পৃথিবীর সব হিসেব-নিকেশ ফুরিয়ে যায়। অথচ এই জীবনের অভিজ্ঞতায় জেনেছি মৃত্যু এলেও থেমে থাকে না মানুষের আক্রোশ, প্রতিহিংসা আর অভিযোগের ফিরিস্তি।


আজ এই অবরুদ্ধ দিনে কেবল মৃত্যুর কথাই ভেবেছি।


এইসব অবরুদ্ধ দিন ভীষণ গুমোট দিন, ভীষণ অনিচ্ছারও দিন। ভাবনা ছাড়া তেমন কিছুই করতে ইচ্ছে করে না।


বন্দিদশা থেকে বের হবো, একটু ছাদে যাবো ভাবতেই মনে পড়ে ছাদে যাবার কোনো উপায় নেই। দুদিন আগে বাড়িওয়ালা তিন তলার ছাদ ঢালাই করেছে। মনে হতেই কোথায় যেন এক ঝলক রোদ উঁকি দেয়। নতুন ছাদে পানি দেওয়া পর্ব শেষ হলে একদিন ছাদে উঠবো। খুব রোদ লাগাবো শরীরে। শরীরে না, প্রিয় লেখক নাসরীন জাহানের মতো পুরো দেহে রোদ লাগাবো। রোদে রোদে পুড়ে দেহে জ্বর আনবো ভীষণ।


দুদিন ধরে এমনিতেই আমার দেহে জ্বর জ্বর। গলাটা ধরে আসে বারবার। কফ জমে থাকে। পিয়াল ভাবে কান্না জমেছে। আমার চোখের পানি না মুছে সে ঠোঁট বিস্মৃত করে হাসে। বলে, ‘মরতে ভয় পাও?’


উত্তর দিই না। চোখের ভেতরে পানি গুঁজি। জগতের সব শোক আর আতংক ভুলে মাথা গুঁজে থাকি বইয়ের ভেতরে, পড়ছি এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট।’


পল বোমার এই মুহূর্তে হাসপাতালে আছে। সহযোদ্ধা আহত কেমারিখকে দেখতে গেছে সে। কেমারিখের মৃত্যু সন্নিকটে। মুলার কিছুতেই মানতে পারছে না কেমারিখের অত সুন্দর বুট জোড়া হাসপাতালের আর্দালি নিয়ে নেবে। সৈনিক কেমারিখের আসন্ন মৃত্যুর চেয়ে তার বুটজোড়ার জন্যই বেশি আফসোস হচ্ছে মুলারের।


অদ্ভুত জায়গা এই যুদ্ধক্ষেত্র। যেখানে এক একটা দিন এক একটা প্রলয়ের মতো। মৃত্যু, ধ্বংস আর নিঃশেষিত হওয়া। সৈনিকদের জন্য প্রাপ্তি বলতে আর কিছুই নেই।


বই পড়ছি আর ফ্রন্টে আহত ঘোড়াদের রক্তহিম করা চিৎকার কানে বাজছে। গোটা পৃথিবী যেন কাতরাচ্ছে। ডেটারিং আহত ঘোড়াদের মৃত্যুকামনা করে লাফিয়ে উঠছে, ‘ঈশ্বরের দোহাই, মেরে ফেল, কেউ গুলি করে মেরে ফেল ওদের, আর সহ্য হয় না।’


যুদ্ধে এসে পল বোমার উপলব্ধি করেছে, এসব যুদ্ধের পেছনে দেশপ্রেম বলে কিছু নেই। যুদ্ধ লাগলে ধনীরাই খুশি হয়, এ যেন ধনী থেকে আরও ধনী হওয়ার এক অব্যর্থ সুযোগ। যুদ্ধক্ষেত্রে যারা থাকে তারা আসলে ভীষণ একা, নিঃসঙ্গ। তাদের পায়ে পায়ে মৃত্যু ঘোরে, তারা জানে জীবন তাদের জন্য না, যে কোনো সময়েই তারা রক্তমাংসের দলা হয়ে যেতে পারে। পল বোমার তাই বিশ্বাস করে ফ্রন্টে ‘দেশপ্রেম কথার ফানুস, মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়ে বড় কিছু নেই।’


ভাবছি, যুদ্ধের মতো দুর্যোগ এলেও বুঝি কেউ কেউ খুশি হয়। সুযোগসন্ধানী হয়। তবে সবকিছুর পরেও মৃত্যুর চেয়ে বড় যন্ত্রণা বুঝি কিছুই নেই।


 
 
 

Comments


Post: Blog2_Post

Subscribe Form

Thanks for submitting!

  • Facebook
  • Twitter
  • LinkedIn

©2020 by সাদিয়া সুলতানা. Proudly created with Wix.com

bottom of page