top of page

পাঠ প্রসঙ্গে-২/অনুর পাঠশালা

  • Writer: সাদিয়া সুলতানা
    সাদিয়া সুলতানা
  • Jun 4, 2024
  • 4 min read



কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের জীবনকে দেখার শিল্পসূত্র ছিল, ‘গল্প লেখার জন্য তোমাকে অত ভাবতে হবে কেন? খাতা কলম বন্ধ করে উঠে পড়। রাজপথের ধারে ঘুরে বেড়াও, ঘুরে বেড়াও নোংরা অন্ধকার গলিতে ও বস্তিতে। দুর্গন্ধে তোমার গা ঘিনঘিন করবে। তবুও তুমি এগিয়ে চল-দেখবে গল্প কবিতার বিষয়বস্তুর ছড়াছড়ি। তুমি চলেছ-একটা রোগা কঙ্কালসার, ঊলঙ্গ-প্রায় ভিখারি এসে তোমার দিকে একটা শীর্ণ হাত বাড়িয়ে বললে: সাহেব একটা পয়সা! তুমি একবার খুব ভালো করে চোখ মেলে তাকাও, তার কাছ থেকে জেনে নাও তার জীবন কাহিনি। বুঝবে বিষয়বস্তুর সন্ধান এদের মতোই শত শত অবহেলিতের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।’’ (মাহমুদুল হক, অগ্রন্থিত গল্পগ্রন্থের প্রসঙ্গ কথা থেকে)

যাঁর জীবন দর্শন এত গভীর, অর্ন্তদৃষ্টি এত তীক্ষ্ম, ভাবনার জগৎ এত সংবেদনশীল-তার সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের ভাঁজে ভাঁজে মানবজীবনের গূঢ় ভাষ্য পরিব্যাপ্ত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবহেলিত প্রান্তিক মানুষের জীবন খুঁটে খুঁটে তিনি আমাদের সামনে অবারিত করেছেন ভিন্ন সব জীবনের পাঠ; প্রসারিত করেছেন আমাদের দৃষ্টিকে, উন্মোচিত করেছেন অন্ত্যজের জীবনবোধের নন্দনতত্ত্ব, বেদনার স্বরূপ।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের (জন্ম ১৯৪০-মৃত্যু ২০০৮) ‘অনুর পাঠশালা’ উপন্যাসটি এমনই এক উপন্যাস যেখানে কেবল একজন কিশোরের চোখের সামনে সমাজজীবনের অচিহ্নিত বা অব্যাখ্যাত রহস্যই উদ্ঘাটিত হয়নি, এই আখ্যানে চিত্রিত হয়েছে মানব সম্পর্কের জটিল সমীকরণ আর প্রান্তিক মানুষের অসহায়ত্বও। উপন্যাসটি ১৯৬৭ সালে রচিত হলেও সময়ের আবহ বিবেচনায় এর প্রাসঙ্গিকতা আজও অক্ষুন্ন।

‘অনুর পাঠশালা’র কেন্দ্রীয় চরিত্র কিশোর অনু। জীবনের অনেককিছুই অনুর ইচ্ছাধীন নয়, অনেককিছু করাই তার বারণ। লামাদের বাগানে প্রজাপতির ঝাঁক নামে, পাখিরা উল্লাস করে, দস্যু ছেলেরা হল্লা করে খেলে। আর ওদিকে অনুর দুপুর কাটে দুঃস্বপ্নে। এর মাঝে অনু জানালার কাছে গেলেই হাতছানি দেয় এক অন্য পৃথিবী। জানালার আকর্ষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হলে অনু জানালার সামনে দাঁড়িয়ে উপভোগ করে সেই পৃথিবীর মাধুর্য। যে পৃথিবী তার দেখা বারণ।

মায়ের কাছে অনু একাধিকবার শুনেছে, ‘ঐসব হাঘরে ইতরদের সঙ্গে তোর অনেক তফাৎ।’ রংতুলি, বই, গান-ঘরের চারদেয়ালের মধ্যে কিশোরবেলার সকল আনন্দআয়োজনই ওর জন্য ছড়ানো আছে, তবু অনুর বুকে শত ‘কাতরতা অঙ্কুরিত হয়।’ ভেতরে ভেতরে গুমরে ওঠে অনু, ভাবে-‘মা কোনো এক মরা নদী। ইচ্ছেরা সব জলেশ্বর মালী। ইচ্ছেরা সব এক একটা চন্দনের পুরানো কৌটা।’

এক একটা বিদীর্ণ দুপুরে সুখী জলেশ্বর মালীর মতো সুন্দর আর ঠান্ডা একটা মেঝেতে চোখ বুজে শুয়ে থাকার জন্য অনু ছটফট করে। এমন ছটফট করতে করতে একদিন অনু ‘নিজেকে অবাক করে নিরুদ্দেশ’ হয়ে যায়, মূলত তখনই উপন্যাসে গতি আসে। ফকিরা, টোকানি, গেনদু, লাটু ফালানি, মিয়াচাঁনদের মার্বেল গড়ানো জীবনে অনু ঢুকে যায়। মানুষের জীবনযাপনের ভিন্ন এক আবহে এসে অনু আবিষ্কার করে জীবনের এই পাঠশালার এই ছাত্ররা ওর চেয়ে অনেক বেশি জানে। অনু চার দেয়ালের পৃথিবীতে হরেক বৈভব মুঠোর মধ্যে পেয়ে বা বই পড়েও যা জানতে পারেনি, ওরা সেসব জানে। পথে পথে ঘোরা এইসব ছেলেমেয়েদের জীবনের সঙ্গে আশ্চর্য এক বোঝাপড়া আছে। মানুষের শরীর, সম্পর্ক আর জীবনের কলকব্জার খুঁটিনাটি সবই ওদের নখদর্পণে।

অনু অবাক হয়ে দেখে শরীরে পাচনকড়ির অসংখ্য কালো দাগ থাকলেও আধপেটা খেতে পাওয়া গেনদুর চেহারায় দুঃখের চিহ্নমাত্র নেই। মিয়াচানের চিনচিনে গলার গান, গেনদুর মালসাট মারা, অবলীলায় খিস্তি-খেউড় আওড়ানো এসবও অনুর জন্য বিস্ময়ের। অনু উপলব্ধি করে; কাচের মার্বেল, কাইবিচি আর মাটির বাঁটুলের মতোন নানান বিকল্প রসদে এরা যেমন করে খেলার উপকরণের ঘাটতি পুষিয়ে নেয় তেমন করে এরা জীবনের ফাঁকফোঁকরগুলোও ভরাট করে ফেলে।

ঘুরতে ঘুরতে ঋষিপাড়ার সরুদাসরি সঙ্গে দেখা হয় অনুর। এরপর সরুদাসীই মূলত অনুর ভাবনার অর্থাৎ উপনাসের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। সরুদাসীর নিঃসংকোচ অনর্গল কথামালা অনুর কাছে রূপকথার মতো লাগে। সরুদাসী অনুকে উপহাসে ক্ষতবিক্ষতও করে। এরপর অনুর জন্য ‘সরুদাসী এক নির্জন কষ্টের নাম’ হয়ে ওঠে। আসলে লেখক চপলা, মুখরা সরুদাসীকে দিয়ে কেবল অনুকে নয় পাঠককেও জীবনের পাঠ শিক্ষা দেন।

‘অনুর পাঠশালা’ উপন্যাসের সমাপ্তি একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত। অনুর ভাবনার মতো বিস্ময়করও। সরুদাসীর খোঁজে অনু যখন কুটিল ঋষিপাড়ার ‘ঘেয়ো জিভের’ মতো উঠানে দাঁড়িয়ে থাকে অনুর মতো বিদ্ধ হতে হতে বিপুল বিস্ময়ে লেখকের গদ্যশৈলীর মোহময়তা উপভোগ করেছি।

উপন্যাসের একটি অংশ উদ্ধৃত না করলেই নয়,

‘‘হাতের চাটি এবং পাখোয়াজের উদ্ধত ধ্বনি এবং ঘনঘন এ-হেই-আই-ও-হুঁহ্ ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে চলেছে। অভিশপ্ত ভূগর্ভের কালো খোল ফেটে পিচকারির মতো তীব্রভাবে উদ্গীরিত হচ্ছে সেই মদোন্মত্ত ধুপধাপ শব্দলহরী। চিড় খাচ্ছে আর দুড়ুম-দাড়াম করে সেখানে সমানে স্থানচ্যুত হচ্ছে কঠিন শিলাস্তর, উত্তপ্ত এবং লেলিহান অগ্নিশিখার মতো হলহলিয়ে উঠছে প্রচণ্ড এবং ক্রোধান্ত তুমুল শব্দরাজি; সাবধান এবং ধ্বংস এবং বজ এবং মাতঙ্গ এবং গাণ্ডিব এবং ব্যাঘ্র এবং হলাহল এবং সিংহ এবং ভুজঙ্গ এবং বৃষ এবং খড়গ প্রভূত শব্দাবলি সেই দুর্দম অগ্নিশিখার মাঝখানে আতসবাজির মতো মুহুর্মুহু ফেটে পড়ছে।’’

লেখক আরও লিখছেন, ‘অনুর মনে হলো বুড়ো হারয়ার হাতের এই প্রলঙ্কর পাখোয়াজ নিঃসৃত শব্দবাণে পৃথিবীর যাবতীয় সভ্যতা ভেঙে চুরমার, খানখান হয়ে যাবে। রক্তবৃষ্টি! মাংসবৃষ্টি! অগ্নিবৃষ্টি! রক্তমাংস অগ্নিবৃষ্টি!’

আবার সরুদাসীর সঙ্গে অনু যখন বৃষ্টিতে ভিজছে তখন শব্দগুচ্ছ যেন হীরকখণ্ডের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে, ‘বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি! ফুঁসে উঠছে হাওয়া, কখনো গলায় ঘুঙুর বাঁধা বাছুরের মতো, কখনো কুঁদুলে ষাঁড়ের মতো শিঙ উঁচিয়ে; কখনো রণোন্মত্ত সিংহের মতো, দুর্দান্ত দস্যুর মতো কখনো।’

এমন বাক্যাবলি, শব্দের এমন মূর্ছনা কেবল বুঝি মাহমুদুল হকের কলম থেকেই বের হওয়া সম্ভব। এভাবে উদ্ধৃত করলে নব্বই পৃষ্ঠার ছোট উপন্যাসটির বেশ অনেকটাই তুলে দিতে হয়। প্রকৃতঅর্থে মাহমুদুল হকের বাক্য নির্মাণের স্বতন্ত্র্য কৌশল তাকে অনন্য করে। যদিও কী যেন নেই, কিছু যেন নেই-এমন এক অনুভবের ভেতরে উপন্যাসের বেশ কয়েকটি চরিত্রকে লেখক পূর্ণাঙ্গভাবে পাঠকের সামনে আনেনি, বরং অনুর বাবা-মায়ের সম্পর্ক, সরুদাসীর প্রস্থান এসবের মাধ্যমে পাঠকের জন্য কৌতূহলের জাল বিন্যস্ত করেছেন।

‘অনুর পাঠশালা’ পড়তে পড়তে আমার চোখের সামনে যেন একটা বিশাল জানালা খুলে যায়, নতুন করে জীবনের পাঠ নিতে নিতে আমি উপলব্ধি করি, বাখারি মাটি আর খোলার পাশের ‘হাজা-মজা নীল সরপড়া নিস্তরঙ্গ’ জলাশয়ের নিথর তলদেশে মাছের ‘এক একটি হলুদ ইচ্ছে’র হারিয়ে যাওয়ার বেদনার স্বরূপ।


#সাদিয়া সুলতানা

 
 
 

Comments


Post: Blog2_Post

Subscribe Form

Thanks for submitting!

  • Facebook
  • Twitter
  • LinkedIn

©2020 by সাদিয়া সুলতানা. Proudly created with Wix.com

bottom of page